পেছনের শিক্ষাক্রমে ফেরার লড়াই প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের
স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সাতবার শিক্ষাক্রম বা শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে সরকার। প্রথম পাঁচবার শিক্ষাক্রমের মূল থিম ঠিক রেখে ৫-১০ শতাংশ পরিবর্তন করা হয়েছিল। তবে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে আনা হয় বড়োসড়ো পরিবর্তন। ওই শিক্ষাক্রমটি ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ নামে পরিচিত। এ পদ্ধতি প্রণয়নের ৯ বছরের মাথায় ২০২১ সালে আবারও শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হয়।
সবশেষ আওয়ামী লীগ সরকার যে শিক্ষাক্রমটি প্রণয়ন করেছিল, তা আগের যে কোনো শিক্ষাপদ্ধতির চেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে। যার মূল কারণ এ পদ্ধতিতে কোনো পরীক্ষা ছিল না। ২০২২ সালে পাইলট প্রকল্পের পর ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। অসন্তোষ থেকে আন্দোলনে নামেন অভিভাবকরা। তাদের দমাতে মামলা-হামলার পথে হাঁটে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। মাত্র একমাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে নতুন শিক্ষাক্রমটি বাতিল করে সরকার। বছরের আটমাস নতুন শিক্ষাক্রম পড়ে আসা শিক্ষার্থীদের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে হয় আগের নিয়মে (সৃজনশীল)। এভাবে চোখের পলকে শিক্ষাক্রম পাল্টে যাওয়ায় তা মানিয়ে নিতে চরম বিপাকে পড়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অবস্থা বেগতিক। আগামী বছর তারা সৃজনশীল পদ্ধতি পড়ে শিক্ষাজীবন এগিয়ে নেওয়া নিয়ে শঙ্কায় ভুগছে।
অভিভাবকরা বলছেন, বছর বছর নতুন শিক্ষাপদ্ধতি চালু করায় তাদের সন্তানরা পড়ালেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। কীভাবে পড়তে হবে, কী প্রশ্ন আসবে, কী উত্তর লিখতে হবে তা বুঝে উঠতে হিমশিম অবস্থা তাদের। অনেকে বিষণ্নতায় ভুগছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের সমস্যা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পড়ালেখায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। হঠাৎ বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। তাদের সাবলীলভাবে ধীরে ধীরে আবারও অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।
আর শিক্ষাক্রম ওলটপালটে শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত জটিল’ উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে যাতে এমন সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্য লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করার তাগিদ দিয়েছেন শিক্ষাবিদরা।
পেছনের শিক্ষাক্রমে ফেরার চ্যালেঞ্জ
২০১২ সালে প্রণীত সৃজনশীল পদ্ধতিকে ‘আধুনিক ও যুগোপযোগী’ তকমা দিয়েছিলেন খোদ শিক্ষাবিদরা। কয়েক বছর পর তারাই আবার এ পদ্ধতি মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন। তখন সরকার ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’ প্রণয়ন করে। এর মাধ্যমে শিক্ষাপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনে আওয়ামী লীগ সরকার।
সবশেষ প্রণীত শিক্ষাক্রমটিতে পরীক্ষা পদ্ধতি বিলোপ করা হয়। শুধু শিখনকালীন ও হাতে-কলমে করা কাজের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন পদ্ধতি করায় শিক্ষাক্রমটি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। একপর্যায়ে তা বাতিলের দাবিতে তুমুল আন্দোলনও করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এসে কিছুদিনের মধ্যেই প্রজ্ঞাপন জারি করে জানিয়ে দেয়, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয়’। এর মধ্যদিয়ে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১’র অবসান ঘটে। ডিসেম্বরে পুরোনো সেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সামনে এগোনো নয়, পেছনের শিক্ষাক্রমে ফেরার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষক-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে যারা নতুন শিক্ষাক্রমে পড়েছে, তাদের জন্য এ চ্যালেঞ্জটা সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকের শুরুর দুই শ্রেণিতে তারা হাতে-কলমে শিখেছে। কোনো পড়া মুখস্ত করতে হয়নি। সৃজনশীল পদ্ধতি কিছুটা বাস্তবিক জ্ঞানের বিষয় থাকলেও মুখস্ত করা ও পরীক্ষায় দীর্ঘসময় লেখার বিষয়টি রয়েছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা পড়তে ও লিখতে হাঁফিয়ে উঠছে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল শাখার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মিফতা জান্নাত। ২০২৩ সালে সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশোনা করেছে সে। যেখানে মুখস্ত করার বিষয় ছিল না। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমে হাতে-কলমে শিখেছে সে। হঠাৎ পুরোদমে পড়া মুখস্ত করতে হয়েছে মিফতার। এতে হিমশিম অবস্থা তার। প্রায় দুই বছরে অভ্যাসগত বড় পরিবর্তন আসায় মুখস্তবিদ্যায় রীতিমতো হাঁফিয়ে উঠছে এই শিক্ষার্থী।
মিফতার মা আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘মেয়েকে পড়তে বসালেই কান্না করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে পড়ে পাঁচটা লাইনও মুখস্ত করতে পারছে না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। মেয়েটা আমার মেন্টালি প্রেসারে (মানসিক চাপ)। বছর বছর পড়ালেখায় এমন পরিবর্তন হলে তো আসলেই মুশকিল।’
মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক আওরঙ্গজেব সলিম বলেন, ‘ওরা তো পড়াই ভুলে গেছে। নামমাত্র পরীক্ষা নিয়ে সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে হয়তো উঠে যাবে এবার। কিন্তু পরে কী যে হবে, সেটা বুঝছি না। শিক্ষকরা হঠাৎ আগের পদ্ধতিতে ফিরলে কেমন পড়াবেন, সেটাও দেখার বিষয়।’
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘এটা সত্য যে, একটা কারিকুলামে পড়তে পড়তে আরেকটাতে ফিরলে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ বাড়বে। এক্ষেত্রে আমরা চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে পরামর্শ দেবো। সিলেবাস কমানো যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করা হবে।’
তবে সিলেবাস কমানো কোনো সমাধান নয় বলে মনে করেন সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের প্রণেতাদের অন্যতম একজন অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কথায় কথায় সিলেবাস কমানো কোনো ভালো সমাধান নয়। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের শিখন ঘাটতি থেকে যায়। তাদের পুরোটা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ছাড় যদি দিতে হয়, তাহলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে দিতে হবে। সেখানে প্রশ্ন কমিয়ে আনা যায়। এক একটি প্রশ্নে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এটা তুলনামূলক ভালো সমাধান বলে আমি মনে করি।’
বিষণ্ন শিক্ষার্থীরা, পড়ালেখায় অতিরিক্ত চাপ নয়
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এমন সমস্যায় পড়েছে। তারা দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমে সম্পূর্ণ পরীক্ষাবিহীন যে পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছে, তাতে হঠাৎ পরিবর্তন আসায় মানসিক অবসাদে ভুগছে। এ নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকরা। তবে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হওয়ায় অনেক অভিভাবক খুশি। এজন্য এ সমস্যাকে তারা ‘খুব বড়’ করে দেখতে চাইছেন না।
অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাবলীলভাবে ধীরে ধীরে পড়ালেখায় আগ্রহী করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ।
তিনি বলেন, ‘শিশুরা ধারাবাহিকভাবে সবকিছু শেখে। ছয় বছর বয়সী একটা শিশুকে আপনি একটা পদ্ধতি শেখালেন। সেটা সে ৮-৯ বছর বয়স পর্যন্ত শিখলো। এরপর হঠাৎ পরিবর্তন। তাতে মানসিকভাবে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটা খুব স্বাভাবিক। এটা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও পড়ালেখায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে বড় বিষয় শিশুদের হঠাৎ বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। তাদের সাবলীলভাবে ধীরে ধীরে আবারও পড়া মুখস্তে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।’
লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন জরুরি
নতুন শিক্ষাক্রম তুলনামূলক বেশি খারাপ মনে করায় তা বাতিলে সাময়িক স্বস্তি ফিরেছে অভিভাবকদের মনে। তবে সন্তানের পড়ালেখা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম চান অভিভাবকরা। এ লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ‘স্থায়ী শিক্ষা কমিশন’ গঠন করা জরুরি বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার অভিভাবক মারজান আক্তার। তিনি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে আন্দোলন করেন। নিজে একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ছিলেন। আন্দোলনে নামায় তাকে চাকরিও হারাতে হয়।
মারজান আক্তার বলেন, ‘বারবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদি ও লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করাটা এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। শিক্ষাখাতে যে সংস্কার আনার উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে, তাতে আমরা টেকসই একটি শিক্ষাপদ্ধতি পাবো বলে আশা করছি। দ্রুত এ সংস্কারকাজ দৃশ্যমান হওয়া উচিত।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমানও লক্ষ্যনির্ভর শিক্ষাক্রমের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এমন একটি শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা উচিত, যা অন্তত ৫-১০ বছরের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের চাকরির বাজারও মাথায় রাখতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এমন দৃষ্টিভঙ্গিমূলক কাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি, ফলে বারবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছি।’
২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রমপ্রণেতাদের অন্যতম একজন অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বারবার শিক্ষাক্রমে এমন পরিবর্তন, অস্থিরতা ঠেকাতে স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন জরুরি। আমরা যখন সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করি, তখন সেখানে স্থায়ী একটি শিক্ষা কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছিলাম। তারা সময়ের আবর্তে শিক্ষায় যে পরিবর্তন আনা দরকার হবে, সেটা করবেন। শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করবেন।’
তিনি বলেন, ‘পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) তো চলছে। সেটা তো সরকার টাকা দিয়ে চালাচ্ছে না। পরীক্ষার্থীদের ফিস দিয়ে চলছে। শিক্ষা কমিশন করলেও সেখানে সরকার স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেটি বিনা পয়সায় চালাতে পারবে। নানান উৎস থেকে শিক্ষা কমিশনের আয় থাকবে। আমি মনে করি, শিক্ষায় অস্থিরতা কাটাতে দ্রুত স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা উচিত।