বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিসহ ২৬ জনের ফাঁসি কার্যকরকারী আলোচিত সেই ‘জল্লাদ’ শাহজাহান মুক্তি পেয়েছেন। দীর্ঘ ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগের পর রোববার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।
‘জল্লাদ’ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। ৭৩ বছর বয়সি শাহজাহান অবিবাহিত। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ। মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ ছিলেন।
কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, শাহজাহান ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম গ্রেফতার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে আসেন। দুটি মামলায় তার ৪২ বছরের সাজা হয়েছিল। পাশাপাশি সেসব মামলায় জরিমানা হয়েছিল পাঁচ হাজার করে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু কারাগারের মধ্যে ভালো কাজ এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করতে জল্লাদের দায়িত্ব পালনের জন্য তার সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) করা হয়। পাশাপাশি শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার জরিমানার ১০ হাজার টাকা পরিশোধ করে দেয়।
কারাগার থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হলাম।’ এ সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তো এখন নিঃস্ব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার আবেদন-আমাকে যেন মাথা গোঁজার ঠাঁই ও কর্মের ব্যবস্থা করে দেন।’
২৬ জনের ফাঁসি দিয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান। কী হয়েছিল ফাঁসির আগে, আসামিকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফাঁসিতে কিছু না কিছু আবেগ থাকে। মানুষ যত অপরাধীই হোক না কেন সে যখন মৃত্যুর মুখে তখন সবারই মায়া লাগে। আমি না হয় মায়া করলাম, কিন্তু আদালত কিংবা আইন তো ক্ষমা করবে না। তাই মায়া লাগলেও আইনের আদেশ পালন করতে গিয়ে ফাঁসি তো দিতেই হবে। কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার ও শীর্ষ জঙ্গিনেতা বাংলাভাইয়ের ফাঁসির আগ মুহূর্তে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরশাদ শিকদারকে ফাঁসি দেওয়ার আগে তিনি বলেছিলেন ‘আমি জীবনে কোনো অন্যায় করেনি, আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আর বাংলাভাই ফাঁসির আগে তেমন কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর যেন আমার ছবি তোলা না হয়।’
ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কী বলেছিলেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কোনো কথা বলেননি। যুদ্ধাপরাধীরাও ফাঁসির আগে কোনো কথা বলেননি।’
ফাঁসির আগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল জানতে চাইলে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ‘একটা মানুষ যতই উচ্ছৃঙ্খল থাকুক না কেন যখন তিনি জেনেছেন মারা যাবেন, তখন তিনি আর কোনো কথা বলেন না, চুপচাপই থাকেন। তিনি কারাগারে থাকার সময় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন বলে জেনেছি। তবে ফাঁসির দিন তিনি কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি। তিনি জানতেন এখানে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে কোনো লাভ নেই। আমাকে চলে যেতে হবে। তাই তিনি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি। সুন্দরমতো চলে গেছেন।’
শহিদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনির ফাঁসির আগে কী বলেছিলেন প্রশ্ন করা হলে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ‘মুনির ফাঁসির আগে বলেছিলেন, আমাকে একটা সিগারেট দেন আমি খাব।’
কারাগারের তথ্য অনুযায়ী, ‘জল্লাদ’ শাহজাহান ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টেনেছেন। যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিল ছয়জন, যুদ্ধাপরাধী ছিল চারজন, জেএমবি ছিল দুজন ও অন্যান্য আলোচিত মামলার আসামি ছিল ১৪ জন।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বলেন, জল্লাদ শাহজাহান পূর্ণ সাজা ভোগ শেষে রেয়াত নিয়োগে অর্থাৎ কারাগারের যে রেমিশন আছে সেই প্রক্রিয়া শেষে আজকে তিনি কারামুক্ত হয়েছেন। জল্লাদ হিসাবে শাহজাহান অনেকের ফাঁসি কার্যকর করলেও তার আচার-ব্যবহার ভালো ছিল।