ঢাকাবাসীর রোজকার জন-জীবনের নিত্যদিনের অন্যতম অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে যানজট, কখনও শেষ হতে না চাওয়া রাস্তার সংস্কার কাজ আর ইট ভাটার দাপটে বেড়ে চলা বায়ু দূষণ। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার এর বিশ্লেষণে অতিসম্প্রতি ঢাকার বায়ুর একিউআই স্কোর দাঁড়িয়েছে ১৭৫ এ। একিউআই স্কোর এর মান ০ থেকে ৫০ এর কোটায় যেখানে ভালো বিবেচনা করা হয় সেখানে ঢাকার বায়ু মান ১৭৫ হওয়ায় সেটা কতটা ক্ষতিকর তা সহজেই অনুমেয়। এ পরিমাণ দূষণ নিয়ে আছে যে বায়ু তাতে আর যাই করা হোক অন্তত সুস্থভাবে শ্বাস নিয়ে বাঁচা দুষ্কর। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশের মত ঢাকা জেলায়ও যত্রতত্র গড়ে উঠেছে মানহীন ইটভাটা। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় এসব ইটভাটার কোনো ছাড়পত্রও থাকে না। ছাড়পত্রহীন এসব ইটভাটা মানছে না আবাসিক এলাকা, মানছে না কৃষি জমি। মালিক পক্ষের একান্ত মর্জি অনুযায়ী অনিয়মে গড়ে উঠছে এসব ভাটা। নরওয়েভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান NILU(নিলু)-র সহযোগিতায় পরিবেশ অধিদফতরের গবেষণায় উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের জন্য ইটভাটা দায়ী ৫৮ শতাংশ, রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস ৬ শতাংশ দায়ী। গবেষণাপত্রটির দিকে চোখ রাখলেই দেখা যায় এ ভয়াবহ দূষণে অপরিকল্পিত ও মানহীন ইটভাটার প্রভাব কতটা দাপটে। দূষণের শতাংশে ২য় স্থানে যে রোড ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট রয়েছে সেটি হয়তো আমাদের দেশের মত দেশ গুলোতেই এমন অপরিকল্পিত। কিংবা আমাদের দেশেই এতটা অপেশাদার কিনা জানা নেই। চীন, জাপানের মত অনেক উন্নত দেশে নির্মাণ কাজ বা সংস্কার কাজ করার সময় এতটা দূষণ তো দূরে থাক অনেকক্ষেত্রে শব্দও শোনা যায় না। যদিও ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালায় নির্মাণকাজের সময় নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখতে এবং নিয়মিত পানি ছিটিয়ে বায়ুদূষণ রোধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয় কি আদৌ সঠিকভাবে মানা হচ্ছে? কতটা মানা হচ্ছে তা ধুলোবালুর কারণে আশপাশের জনসাধারণকে দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে আর পথচারীদের নাকে রুমাল চেপে হাঁটাচলা করতে দেখলেই বুঝা যায়। শব্দদূষণ তো দিনভর আছেই, এটাকে উপরি পাওনা হিসেবেই বলা যায়। ঢাকার দূষিত বায়ুতে যেসকল উপাদান পাওয়া যায় তাদের মধ্যে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, পিএসসি, পার্টিকুলেট ম্যাটার ধূলিকণাসহ দূষণের ছয় থেকে সাতটা উপাদান অন্যতম। এসব দূষিত বাতাসে যে পরিমাণ সালফার ডাই অক্সাইড থাকে তা পানিতে মিশে চোখে জ্বালাপোড়া করায়। এতে ফুসফুসে প্রদাহ থেকে শুরু করে অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও দেখা দেয়। বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যান নেই। তবে চিকিৎসকেরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত রোগ বাড়ছে। গত পাঁচ বছরের তুলনায় এখন রোগীর সংখ্যা দুই থেকে তিন গুণের বেশি বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে রোগীর চাপ আরও বাড়ে। এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। অটিস্টিক শিশুর জন্ম হওয়ার একটি কারণ দূষিত বায়ু। বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন কম হওয়ার একটি কারণও বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। হাঁচি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসার। এই ক্যানসারের বড় কারণ দূষিত বায়ু। এ ছাড়া কিডনি ও হৃদরোগের কারণও হতে পারে বায়ুদূষণ। এসব ভয়াবহ দূষণ থেকে উদ্ধার পেতে করণীয় হলো, এ সংক্রান্ত যে সকল আইন ও নিয়ম আছে সেগুলো মেনে চলার কোনও বিকল্প নেই। এসবের কারণে শুধুমাত্র ঢাকা দূষিত হচ্ছে তা নয়, প্রায় সারাদেশেরই কম-বেশি মাত্রায় একই পরিবেশ। তবে দূষণ ঠেকাতে যে নিয়ম আইন আছে সেগুলো না মানার কারণে ঢাকার দূষণ বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান প্রক্রিয়া, সেটি তো বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু সেখান থেকে যেন ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহের ওপর প্রভাব না ফেলে সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা এই বায়ুদূষণ সহ অন্যান্য আরো যে সমস্ত দূষণে আক্রান্ত তার প্রধান কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যার বসবাস। আমাদের এই রাজধানী মূখী যাত্রার ফলে এখন ঢাকার জনসংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। জনসাধারণের সাথে পাল্লা দিয়ে নিয়মিত ভাবেই বাড়ছে হরেক রকম যানবাহনের সংখ্যাও। আর এই যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে উপার্জন করা। তাই সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে যদি বিভিন্ন ফ্যাক্টরি, গার্মেন্টস, কারখানা গুলো পরিকল্পিত ভাবে নির্দিষ্ট হারে ঢাকার বাহিরে স্থাপন করা যায় তবে হয়তো এ জন চাপ কিছুটা হলেও হ্রাস করা যাবে। দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে সারাদেশের সাথেই রাজধানীর যোগাযোগ ভালো রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেগুলোতে বেশি সংখ্যক লোকজন কর্মরত আছে সে প্রতিষ্ঠান গুলোকে জনসংখ্যার কম ঘনত্বে থাকা বিভাগে স্থানান্তর করা যেতে পারে। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কার্যকর পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। তবেই হয়তো কিছুটা হলেও সবুজের, নির্মলতার ছোঁয়া পাবে আমাদের এই স্বপ্নের শহর ঢাকা। পরিকল্পিত নগরী-ই হতে পারে দূষণ মুক্ত বাতাসের মাধ্যম। লেখকঃ নোমান আব্দুল্লাহ শিক্ষার্থী, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ।