1. admin@bdprothombarta.com : admin :
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস - বিডি প্রথম বার্তা
মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:২৫ পূর্বাহ্ন

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত : শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
  • ৮৮ বার পঠিত
১১ মার্চের গ্রেফতার ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৩ মার্চ ১৯৪৮ থেকে ২৫ মার্চ ১৯৪৮ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচিঃ
১৩ মার্চ পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হয় এবং পরিষদ ২৫ মার্চ পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ মার্চ পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা থাকায় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ধর্মঘট সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
১৫ মার্চের ধর্মঘটে ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও সেক্রেটারিয়েটসহ রমনা এলাকার বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারী এমন কি রেল কর্মচারীরাও শামিল হয় এবং ভাষার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এভাবে ভাষার দাবিতে আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পরিষদের নেতাদের সাথে আপোসরফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও নাজিমউদ্দীনের মধ্যে আট দফা দাবি সম্বলিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির দাবীগুলো ছিল নিম্নরূপ:
১. ভাষা আন্দোলনে ধৃত বন্দীদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে।
২. পূর্ব বাংলার আইনসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, পূর্ব বাংলার অফিস আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা।
৩. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে পূর্ব বাংলার আইনসভা বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করবে।
৪. ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
৫. পুলিশ কর্তৃক ভাষা আন্দোলনকারীদের অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে বিবৃতি দিবেন।
৬. সংবাদপত্রের উপর থেকে নিষেদাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৭. ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে পূর্ব বাংলার যেসব স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে সেখান থেকে তা প্রত্যাহার করা হবে।
৮. ভাষা আন্দোলনকারীরা পাকিস্তানের শত্রু নয়, মঙ্গলকামী বলে বিবৃতি দিতে হবে।
চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বে আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে আটক শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখ ছাত্র-নেতার সাথে দেখা করেন এবং তাদেরকে চুক্তিটি দেখান। তাঁরা চুক্তির দাবীগুলো দেখার পর সেগুলো সমর্থন ও অনুমোদন করেন। এরপর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বর্ধমান হাউসে ফিরে এলে সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং সগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দীন আহমদ চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে পুলিশ ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ ও কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে করে ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এক বিরাট মিছিল সহকারে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সামনে এসে হাজির হয়। তমদ্দুন মজলিস নেতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ছাত্রদের শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দীনের সাথে তাদের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি বলেন। এতে করে ছাত্ররা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং আবুল কাসেমকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে।
এসময় তোয়াহা প্রমুখ ছাত্রনেতা দ্রুত সেখানে এসে ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, চুক্তিটি চূড়ান্ত কিছু নয়, এটাকে কেন্দ্র করে শুধু আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। সরকার যদি তাদের ভাষা সম্পর্কিত দাবি না মানে তবে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। তারপরও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে এবং দাবি করে যে, স্বয়ং নাজিমুদ্দীনের মুখ থেকে চুক্তিটি সম্পর্কে শুনতে চায়। কিন্তু নাজিমুদ্দীন সেখানে না উপস্থিত হওয়ায় ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত ছাত্রনেতারা বাধ্য হয়েই পরদিন অর্থাৎ ১৬ মার্চ ধর্মঘট আহবান করে।
সেদিনই অর্থাৎ ১৫ মার্চ চুক্তি অনুযায়ী ভাষা আন্দোলনে বন্দী ছাত্রদের মুক্তি দেয়ার জন্য জেল গেটে আনা হলে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেদিন কমিউনিস্ট নেতা সত্যেন সেন, রনেশ দাশগুপ্ত ছাড়াও জাকির হোসেন, শওকত, আলী, কাজী গোলাম মাহবুব প্রমুখের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে মামলা থাকায় তাদের মুক্তির নির্দেশ আসেনি। ফলে তাদেরকে বাদ দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য বন্দীরা জেলখানা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। এতে করে জেলগেটে চরম উত্তেজনা ও হৈ হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাকে একটি ট্রাকে করে সারা শহর প্রদক্ষিণ করানো হয় এবং সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে তাদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
১৬ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে ১৫ মার্চ সম্পাদিত চুক্তির কয়েকটি স্থান সংশোধন করে সেই সংশোধনী প্রস্তাব সাধারণ ছাত্র- ছাত্রীদের সভায় পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শেখ মুজিব সেই নির্ধারিত ছাত্রসভায় উপস্থিত হলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে সেই সভায় সভাপতিত্ব করার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিব তাতে রাজী হন এবং তাঁর সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। সভায় নিম্নোক্ত প্রস্তাবগুলো গৃহীত হয়:
১. ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়োগ করতে হবে।
২. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের সুপারিশ করে প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করতে হবে।
৩. সংবিধান সভা কর্তৃক তার উপরোক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করাতে ব্যর্থ হলে সংবিধান সভার এবং পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে।
প্রস্তাবগুলো গৃহীত হবার পর সেটি অলি আহাদের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শেখ মুজিব এরপর বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন এবং বক্তৃতা শেষে সাধারণ ছাত্রদের পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবার আহবান জানান। এরপর এক বিরাট মিছিল সহকারে তিনি পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হন এবং মিছিলের পুরোভাগে থেকে স্লোগান তোলেন, “চলো চলো এ্যাসেম্বলি চলো” । মিছিলটি পরিষদ ভবনের কাছে এলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। ছাত্ররা এতে বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও পুলিশী নির্যাতনের অবসান দাবি করে। এসময় পুলিশ লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও বন্দুকের ফাকা আওয়াজ শুরু করলে শওকত আলীসহ ১৯ জন ছাত্র মারাত্মক আহত হন। এরপর ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদ ১৭ মার্চ ঢাকায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও বিক্ষোভের কর্মসূচী গ্রহণ করে। পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৭ মার্চ ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়।
এভাবে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতার সুযোগ্য ও সাহসী নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন সারা প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং তা গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনে শুধু ছাত্র সমাজই নয় ছাত্রনেতাদের বিশেষ করে শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে বৃদ্ধ বয়সে ফজলুল হকও অংশগ্রহণ করেন এবং পুলিশী নির্যাতনের শিকার হন। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মযহারুল ইসলাম লিখেছেন:
শেখ মুজিব একজন বলিষ্ঠ প্রত্যয় সম্পন্ন এবং অসমসাহসী যুবনেতা হিসেবে ছাত্র-সমাজে এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আব্দুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতার কঠোর সাধনার ফলে বাংলা ভাষার আন্দোলন সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি গণ আন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা, মিছিল আর শ্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায় দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ‘রাষ্ট্রভাষা বংলা চাই’। দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্ত ভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ওতপ্রােত সম্পর্কে যারা নিরলস কাজ করেছেন সেইসব ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেবার বেলায় অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয় এমনকি তারই প্রেরণায় ৭৬ বছরের বৃদ্ধ শেরে বাংলা ফজলুল হক পর্যন্ত এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিলেন।… ছাত্রদের ওপর হামলা চালালো । এমনকি, তারা শেরে বাংলাকেও আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করল না।
যাই হোক, সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১৭ মার্চ হরতাল পালিত হয়। সেদিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় ১৯ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আগমন উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরবর্তী ধর্মঘট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
Facebook Comments Box
এ জাতীয় আরও খবর
© All rights reserved © 2022 BD Prothom Barta
Theme Customized BY LatestNews